রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ০৮:০৪ অপরাহ্ন
দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়ার গুলতেরা মঞ্জিলের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে রায়হান আহমদ (৩৩)। গত বছর তার আবেদনে সাড়া দেয় মার্কিন দূতাবাস, ডানা মেলতে শুরু করে রায়হানের স্বপ্ন। কিন্তু ভিসা পাওয়ার স্বপ্ন পূরণের একেবারে দ্বারপ্রান্তে রায়হান নিজেই হারিয়ে গেলেন। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে তাকে।
পরিবারের সদস্যদের এমন অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে তদন্তও শুরু করেছে পুলিশ। গতকাল সোমবার ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত ও আরও তিন পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এদিকে গত রোববার রাত ২টার দিকে কোতোয়ালি মডেল থানায় রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নি বাদী হয়ে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর অভিযোগে একটি হত্যা মামলা (নং-২০(১০)২০) করেছেন। মামলায় আসামিদের নাম উল্লেখ না করলেও পুলিশকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই হত্যার কারণ সম্পর্কে কোনো কিছু এখনও জানা যায়নি। প্রসঙ্গত, রায়হানকে আটক করার পর ১০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। তবে রায়হানের মামাতো ভাই আব্দুর রহমান সমকালকে বলেছেন, ১০ হাজার টাকার জন্য নয়। কারও মদদে পুলিশ তাকে হত্যা করেছে। আব্দুর রহমান এ ঘটনার বিচার দাবি করে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনের ও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
পুলিশ প্রথমে দাবি করেছিল, রোববার ভোররাতে নগরীর কাস্টঘর এলাকায় ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনিতে রায়হান মারা গেছেন। কিন্তু বিষয়টি শুরু থেকেই মানতে নারাজ ছিল তার পরিবার। তারা পুলিশি নির্যাতনে হত্যার অভিযোগ তোলেন। এদিকে কাস্টঘর এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ অনুসন্ধান করে কোনো গণধোলাইয়ের দৃশ্য মেলেনি। স্থানীয় কাউন্সিলরও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এজাহারে যা বললেন তান্নি : পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারাসহ হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের অভিযোগে করা মামলার এজাহারে তাহমিনা আক্তার তান্নি উল্লেখ করেন, গত শনিবার বিকেল ৩টার দিকে তার স্বামী রায়হান আহমদ নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটে নিজের কর্মস্থল ডা. গোলাম কিবরিয়া ও ডা. শান্তা রাণীর চেম্বারে যান। পর দিন ১১ অক্টোবর ভোর ৪টা ৩৩ মিনিটে কনস্টেবল তৌহিদের ০১৭৮৩৫৬১১১১ মোবাইল ফোন নম্বর থেকে তার শাশুড়ির (রায়হানের মা সালমা বেগম) ব্যবহূত সেলফোনে কল দেওয়া হয়। ফোন রিসিভ করেন রায়হানের চাচা, সৎ পিতা হাবিবুল্লাহ। ফোনে রায়হান আর্তনাদ করে বলেন, তিনি বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আছেন। তাকে বাঁচাতে হলে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে যেতে হবে। রায়হানের চাচা ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে রায়হানের খোঁজ করলে দায়িত্বরত একজন পুলিশ জানায়, তিনি ঘুমিয়ে গেছেন। যে পুলিশ রায়হানকে ধরে নিয়ে এসেছে, সেও চলে গেছে। হাবিবুল্লাহকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ফাঁড়িতে আসতে বলা হয়।
হাবিবুল্লাহ সকাল পৌনে ১০টার দিকে আবারও ফাঁড়িতে গেলে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য জানান, রায়হান অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রায়হানের চাচা ওসমানী হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারেন, রায়হানকে সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে তিনি মারা যান। মর্গে গিয়ে হাবিবুল্লাহসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়স্বজন রায়হানের ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখতে পান।
এজাহারে তান্নি আরও উল্লেখ করেন, তার স্বামীকে কে বা কারা বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে গিয়ে পুলিশি হেফাজতে রেখে হাত-পায়ে আঘাত করে এবং হাতের নখ উপড়ে ফেলে। পুলিশ ফাঁড়িতে রাতভর নির্যাতনের ফলে তার স্বামীর মৃত্যু ঘটেছে। এদিকে সুরতহাল রিপোর্টেও নখে আঘাত, ডান হাতে ও ডান পায়ে আঘাতের উল্লেখ রয়েছে।
ফুটেজ বলছে ভিন্ন কথা : এদিকে রায়হানকে কাস্টঘরে ছিনতাইকালে গণপিটুনি দেওয়া হয়, পরে তার মৃত্যু ঘটে- পুলিশের এই দাবির সত্যতা মেলেনি। সিটি করপোরেশনের ওই এলাকার সিসিটিভিতে ধারণ করা ফুটেজে এমন কোনো ঘটনার দৃশ্য মেলেনি। সিটি করপোরেশনের ১৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মোনিম ফুটেজ দেখে সমকালকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া সোমবার সকালে কাস্টঘর এলাকায় সরেজমিন খোঁজ করেও জানা গেছে, রোববার ভোরে ছিনতাই কিংবা গণধোলাইয়ের কোনো খবর স্থানীয়দের জানা নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী জানান, ভোরে কোনো দোকান খোলে না। পথচারীও তেমন থাকে না। গণধোলাই করার মতো লোক কোত্থেকে আসবে? এমন কোনো ঘটনা ঘটলে নিশ্চয়ই সবাই জানত।
বরখাস্ত ও প্রত্যাহার : বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশি নির্যাতনে রায়হানের মৃত্যুর ঘটনায় বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়া, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ ও টিটুকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই সঙ্গে এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজীব হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপকমিশনার (মিডিয়া) জ্যোতির্ময় সরকার। তবে তাদের নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ। পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ। উপপুলিশ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ গতকাল কোতোয়ালি থানার ওসিকে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে ৬৩৫৭ স্মারকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
স্বজন ও জনপ্রতিনিধিরা যা বলছেন : এক সময় রায়হান সিলেট স্টেডিয়াম পাড়ায় ডাক্তারদের চেম্বারে কাজ করতেন। বিয়ের আগে এ কাজ ছেড়ে দিলেও সম্প্রতি তিনি আবারও ডাক্তারপল্লিতে যাতায়াত শুরু করেন। রায়হান আর তান্নির আলফা নামে এক শিশুকন্যা রয়েছে। পারিবারিকভাবে সচ্ছল রায়হান ২০০৬ সালে আমেরিকা যেতে আবেদন করেন। সম্প্রতি তার কাছে চিঠিও আসে। ভিসা পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছিলেন রায়হান। এলাকায় তার কোনো শত্রু নেই। রায়হানকে ভদ্র বলেই জানেন এলাকার লোকজন। রায়হানের ক্লাসমেট রেজা রুবেল জানান, রাগ করার মতো কোনো বিষয় নিয়ে কথা বললেও রায়হান রাগ করে কথা বলত না।
৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মখলিছুর রহমান কামরান বলেন, পুলিশ হেফাজতেই রায়হানের মৃত্যু হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। তার বিরুদ্ধে তো এলাকায় কোনো অভিযোগ নেই। রায়হানের ভাই আব্দুর রহমানও বলেন, তার নামে কোনো মামলা নেই। পুলিশ মিথ্যা দাবি করছে। তবে দুই বছর আগে রায়হানের ভাড়াটিয়ার ঘর থেকে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ তাকে আটক করে মামলা দেয়। সেই মামলায় তিনি জামিনে আছেন। এদিকে রায়হানকে হত্যার অভিযোগে আখালিয়া এলাকায় গতকাল সোমবার মানববন্ধন করেছেন স্থানীয়রা। তারা হত্যার বিচার দাবি করেছেন। এ মানববন্ধনে স্ত্রী তান্নিও উপস্থিত ছিলেন। তাকে কান্না করতে দেখা গেছে।
পুলিশ হেফাজতে রায়হানের মৃত্যু সম্পর্কে এসএমপির উপপুলিশ কমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোতির্ময় সরকার বলেন, পুলিশ পুরো বিষয়টি তদন্ত করছে। অনেক কিছু সামনে রেখে পুলিশ অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র :- সমকাল